সুন্দরবন, সাইক্লোন – বিপর্যয় এবং তার প্রতিকার : পর্ব ৩
নদী বাঁধ ভাঙ্গা এবং ম্যানগ্রোভ হারিয়ে যাওয়ার পিছনে এলাকার সাধারন মানুষেরাও কম দায়ী নয়। উত্তর ২৪ পরগনা জেলার একদম শেষ প্রান্তে হিঙ্গলগঞ্জ, লেবুখালী ছাড়িয়ে সমশেরনগর গিয়েছিলাম। ছোট এক নদীর অন্য তীরেই বাংলাদেশ। দেখেছি বাংলাদেশের দিকের নদী পাড় একদম অটুট রয়েছে, সেখানে নদীকূল বরাবর গাছের জঙ্গল। অথচ ঠিক এপারেই তীর বরাবর যতদূর চোখ যায় পুরোটাই প্রায় ভাঙ্গা, পাড়ে গাছ প্রায় নেই বললেই চলে। সেখানকার স্কুলের এক মাস্টারমশায়কে এর কারণ জিজ্ঞাসা করায় বললেন, আজ থেকে চল্লিশ বছর কিংবা তারও কিছু আগে যখন থেকে এই এলাকায় বাগদা চিংড়ির মীন আসতে শুরু করেছিল বাগদার মীন ধরার জন্য আমাদের এই এলাকার গরীব মানুষেরা ছেলে-বুড়ো, নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই ব্যাপকভাবে নদীতে নেমে বাগদার মীন ধরতে শুরু করল। আর এই মীন ধরতে গিয়ে দিনরাত তারা নদীর পাড়ে নেমেছে। জোয়ার ভাটায় সমানে মীন ধরার চেষ্টা করে গেছে। এর ফলেই ব্যাপকহারে নদীতীর ভেঙে গেছে। সেই একই সময় কিন্তু বাংলাদেশের পারের লোকেরা মীন ধরার জন্য যথেচ্ছভাবে নদীতে নামেনি। তারা নৌকোয় বসে জাল ফেলে মাছ ধরত। যেহেতু তারা পাড় দিয়ে নদীতে নামত না, সেজন্য তাদের দিকের পাড় ভাঙ্গেনি। এব্যাপারে আগেও আমাদের থেকে বাংলাদেশের লোকেরা অনেক বেশি সচেতন ছিল, এখনও অনেক বেশি সচেতন। ওরা নদীর পাড় দিয়ে কাউকে জাল নিয়ে নামতে দেয় না। ওদের যারা নদীতে নামে তাদের সবাইকে নৌকো নিয়ে নামতে হয়, আর যেখান সেখান দিয়েও নদীতে নামতে দেয় না। ওদের পারে নদীতে নামার একটাই রাস্তা, সেই রাস্তা দিয়েই নদীতে নামতে হবে। যে যার মতন যেখানে খুশি, সেখান দিয়ে নদীতে নামতে পারবে না। এটাই ওদের নিয়ম। ফলে ওদের দিকের পাড় অটুট রয়েছে।
আর এই ব্যাপক হারে এপারের পাড় ভাঙার ফলে সেই পাড়ের মাটি ওদের দিকে গিয়ে এক বিশাল চর তৈরি করে দিয়েছে। বর্তমানে সেটা বাড়তে বাড়তে প্রায় মাইল পাঁচেক লম্বা এক চর তৈরি হয়ে গিয়েছে। ওই চর গড়ে ওঠার জন্য জোয়ারের সময় জল বাংলাদেশের দিকে ঢুকতে পারছে না। সেই জল ঢুকে যাচ্ছে আমাদের দিকে। ফলে এপাশের পাড় আরও ভেঙে যাচ্ছে। ওদিকের পাড় অক্ষত থাকার জন্য ওদের পাড়ের জঙ্গল পুরোটাই রয়ে গেছে, সেই জঙ্গল নদী বাঁধকে আরও মজবুত করেছে। ভারতবর্ষের দিকের নদী বাঁধ ক্রমাগত ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে এদিককার ম্যানগ্রোভ গাছের জঙ্গল প্রচন্ড রকমের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার উপর চর নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে নতুন করে ম্যানগ্রোভ জঙ্গল তৈরি হয়নি। তার জন্য ঝড়ঝাপটাতে এই বাঁধগুলোর অবস্থা আরও সঙ্গীন হয়ে যাচ্ছে। বাঁধগুলোর সামনে ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের কোন প্রোটেকশন না থাকার ফলে খুব বড় জোয়ার-ভাটা এলে বা ঝড়ঝাপটা হলে পাড় ভেঙে জলস্তর ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। সাধারন জীবনযাপন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
নদীবাঁধ ভাঙ্গা এবং ম্যানগ্রোভ হারিয়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ ইট ভাটা। ওই অঞ্চলে বিভিন্ন নদীর মাঝে মাঝে পলি জমে প্রাকৃতিক চর তৈরি হয়। চরের সেই মাটি ইট তৈরীর মূল উপাদান। ইটের প্রয়োজনে ভাটা মালিকেরা নদীচর থেকে পলি তুলে আনে। সেই ইট বিভিন্ন জায়গায় সাপ্লাই হয়। বেশী লাভের আশায় যথেচ্ছভাবে পলি কেটে নেয় তারা। এভাবেই যে এলাকায় ভাটা রয়েছে সেই এলাকার চরগুলো পুরোপুরি কেটে তুলে আনা হয় ইট তৈরীর উদ্দেশ্যে। এই সব পলির চরে ম্যানগ্রোভ গাছ প্রচুর পরিমাণে জন্মায়। কিন্তু চরগুলো কেটে নেবার জন্য সেখানে ম্যানগ্রোভ গাছ জন্মানোর সুযোগ থাকছে না। চরের ম্যানগ্রোভ জঙ্গল জলের ধাক্কা থেকে নদী বাঁধকে অনেকটা সামলে রাখতে পারে। চর কেটে নেবার ফলে ম্যানগ্রোভ গাছ না জন্মানোর জন্য কাছাকাছি নদী বাঁধ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পলি সংগ্রহ করার আর এক পদ্ধতি হল বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় গোলাকার গর্ত কেটে অর্থাৎ রিং তৈরি করে সেখানে নদীর জল ঢুকিয়ে সেই গর্তে ধীরে ধীরে নদীর পলি জমায়। দিনে দিনে সেই জমা পলি দিয়ে গর্ত ভর্তি হয়ে গেলে সেই পলি কেটে তুলে ইট তৈরি করা হয়। ফের নদীর জল ঢুকিয়ে সেখানে পলি জমায়, আর এই ভাবেই পলি কাটা চলতে থাকে। যদিও সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী বর্তমানে মাটি কেটে ইট তৈরি করা নিষেধ, কিন্তু সেই নিয়মের কোনও তোয়াক্কাই করে না এরা। বিদ্যাধরী নদী এবং অন্যান্য নদীর পাশ দিয়ে যত ইটভাটা আছে, খোঁজ নিলে দেখা যাবে তার প্রায় সবই অবৈধ। আর সাধারণ অধিবাসীরা তাদের জমি ইটভাটা কিংবা ভেড়ির মালিকদের হাতে তুলে দিচ্ছে, বা গাছ কাটছে, হরিণ বা অন্যান্য প্রাণী মারছে, কিংবা বিভিন্নভাবে আয়ের আশায় জঙ্গলের দিকে অন্যায়ভাবে প্রবেশ করছে তার প্রধান কারণ হচ্ছে তাদের নিজেদের জীবিকার অভাব। তাদের নিজস্ব জীবিকা ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে গেছে কিংবা যাচ্ছে। সেই নষ্ট হওয়া জীবিকাগুলো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সফলভাবে প্রয়োগ তাদের শিখিয়ে সেই জীবিকাতে তাদের উৎসাহিত করতে হবে। সুন্দরবনের নোনা এলাকার জমিতে কিন্তু বছরে তিন-চারবার ফসল কোনদিনই হয় না। অন্যান্য জেলার তুলনায় এখানে ধান চাষ হয় কম। যেসব ধানগুলো নোনা জলে ভালো চাষ হয় সেখানেও সেই নোনাজলের ধান খুব একটা অর্থকরী শস্য নয়। সেখানে এর পাশাপাশি আর কি কি উপায়ে নতুন নতুন জীবিকা তৈরি করা যায়, সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। তার দিশা এখানকার চাষিদের দেখাতে হবে। বিভিন্ন রকম চাষ কিভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আরও ভালভাবে করা যায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এলাকার লোকেদের সুন্দর ভাবে শেখাতে হবে সেসব। ধান ছাড়াও শেখাতে হবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ, সবজি চাষ, মধু চাষ ও তার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রসেসিং, ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের জীবিকা। খুব অল্প সময়েই শেখানো যায় জলের লবণের পরিমাণ কি ভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মাপা যায়, কিংবা কোন পুকুরের অপরিস্রুত জলে কতটা চুন-ফিটকারি মেশালে তা পরিস্রুত হতে পারে। এসব কাজের জন্য প্রয়োজনীয় মেশিন বেশ সহজলভ্য। স্যালিনিটি মেজারমেন্ট আর pH মেজারমেন্ট ইন্সট্রুমেন্ট এর দাম সবমিলিয়ে সাধারনের আয়ত্ত্বের মধ্যেই। এবং এটাও প্রত্যেক চাষির আলাদা আলাদা করে কেনার কোনও প্রয়োজন নেই, সমস্ত গ্রামের জন্য একটা সেট কিনে নিলেই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে গ্রামের সবাই সেটা ব্যবহার করতে পারবে। সেটা দিয়ে গ্রামের সবার প্রয়োজন মেটানো সম্ভব। এসব যন্ত্রপাতির সহজ প্রয়োগে এভাবে খুব অল্প খরচেই সবাই বুঝে যাবে তার জমির কিংবা পুকুরের লবণাক্ত ভাবের পরিমাণ।
সহজভাবে বোঝাতে গেলে, সচরাচর একটা পাঁচ কাঠার পুকুরে ৫ কিলো ফিটকিরি এবং তার দ্বিগুণ মাপের চুন ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ সহজে মনে রাখতে গেলে, প্রতি কাঠায় এক কিলো ফিটকিরি। তবে যেহেতু সব লবণাক্ত ভাবের পরিমাণ এক রকম হবে না, তাই এমন না যে সমস্ত জায়গার পুকুরের জল পরিস্রুত করার জন্য একই মাপের চুন-ফিটকিরি ব্যবহার হবে। এমন করলে কোন কোন ক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হবার সম্ভাবনা থাকতে পারে। খুব সহজেই এই শিক্ষাগুলো এলাকার লোকেদের দেওয়া যায় – কোন জলে কতটা চুন দেওয়া দরকার, কতটা ফিটকারি মেশালে জলটা মাছ চাষের উপযোগী হবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। চাষের উন্নতির জন্য এই বেসিক শিক্ষাগুলো প্রথমেই দেওয়া দরকার। পুকুরের জলের স্বভাব সঠিক না জেনেই নিজের মর্জি মতন কিছু চুন কিংবা ফিটকিরি পুকুরে ঢেলে দিলে তাতে উপকারের বদল অপকার হওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যায়। সেক্ষেত্রে সেই একই পুকুরে পরবর্তী দু-তিন বছর হয়তো মিষ্টি জলের মাছের চাষ হবে কিন্তু যতটা পরিমাণে পাওয়ার কথা হয়তো দেখা যাবে পাওয়া যাচ্ছে তার থেকে অনেক কম। কোন কোন ক্ষেত্রে অর্ধেকেরও কম হতে পারে উৎপাদন। সুন্দরবনের সাধারন লোকেদের প্রথমেই এই প্রাথমিক শিক্ষাগুলো দেওয়া দরকার।
একই ভাবে ওই এলাকার গবাদিপশু পালনের ব্যাপারটাও খেয়াল রাখতে হবে। এমন না যে মাঠে ছেড়ে দিলে, আর শুধু ঘাস কিংবা পাতা খেলেই একটা গরুর পরিপূর্ণ দুধ হবে, এ ছাড়া আর কোনও উপায় নেই তার দুধ বাড়ানোর। গবাদিপশু পালনও যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে করা যায় সেটাও জানতে হবে। সেই গরু ছাগলকে কিভাবে খাবার দিলে তার থেকে সবথেকে বেশি পরিমাণে উৎপাদন পাওয়া যেতে পারে, সেই ব্যবহারিক প্রয়োগগুলো শেখানোর দরকার। সে ক্ষেত্রে দেখা যাবে গরু ছাগলকে ঠিক পরিমাণে অন্য খাবার দিলে তারা এই ম্যানগ্রোভ গাছ গুলোর উপরে হামলা করবে না। সেই গাছগুলো বেঁচে যাবে। শুধু ম্যানগ্রোভ নয়, এছাড়াও বিভিন্ন গাছ, যেমন শিরীষ কিংবা অন্যান্য ফলের গাছ সেগুলোও গবাদিপশুর হাত থেকে বাঁচাতে গেলে সেই এলাকার অধিবাসীদের শেখাতে হবে গাছ বাঁচিয়ে কিভাবে সেই গবাদিপশু পালন করতে হয়। একই সঙ্গে একেকটা গ্রাম ধরে এই ছোট ছোট ব্যাপারগুলো শেখাতে হবে ওদের। শেখাতে হবে কিভাবে তাদের জীবন-জীবিকা পরিপূর্ণ ভাবে সুন্দর ভাবে করা যায়, যাতে তারা অন্য দিকে আকৃষ্ট না হয়।
হঠাৎ করে গিয়ে যদি কোন চাষিকে বলা হয় ভেড়ির চাষ তোমরা করবে না, এতে তোমাদের ভবিষ্যতে ক্ষতি হবে; ১০ বছর, ১৫ বছর, কি ২০ বছর বাদে সুন্দরবন আর থাকবে না, ওদের মাথায় তো খুব স্বাভাবিকভাবেই আসবে ১৫ বছর বাদে কি হবে তার জন্য আমি এখনই কেন ভাবব? আগে এই ১৫ বছর আমি সংসারের সবাইকে নিয়ে খেতে পারব, সুস্থ থাকব, বেঁচে থাকব, তবেই তো ১৫ বছর বাদের সুস্থ জীবনের কথা ভাবব! কারণ তার সেই জমি ভেরির মালিককে দিলে দেখা যাচ্ছে বছরে ন্যূনতম সাত-আট হাজার টাকা পাচ্ছে সেই জমি থেকে। যেখানে ধান চাষ করে, নিজে গায়ে গতরে খেটে সেই জমি থেকে খুব বেশি হলে তার লাভ থাকে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। এই পরিস্থিতিতে তাকে কোনও বুদ্ধি দিতে গেলে সে তো প্রথমেই বলবে, রাখো তোমার এইসব বড় বড় কথা। আমি তো জমি দিয়ে বসে বসেই ১০,০০০ টাকা পেয়ে যাচ্ছি। তাহলে আমি কেন মিছামিছি অত খাটতে যাব? তার উপর ওই গরুর খাটুনির পর হাতে তেমন কোনও টাকাও পাব না। কেন নিশ্চিন্ত, অবসর জীবন কাটাব না? সেজন্যই হয়তো তারা সারাদিন তাস খেলে কিংবা বিনা কাজে দিন কাটাচ্ছে। তারা দেখতে পাচ্ছে এটাই তাদের আরামের জীবন। অহেতুক কেন খাটাখাটনি করে সেই একই সময়ে তার থেকে অনেক টাকা কম আয় করবে? এই যে তাস খেলছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং বসে বসে টাকা ইনকাম হচ্ছে এই সহজ জীবনটা যে আসলে সহজ নয়, ভবিষ্যতে এটাই কঠিন হয়ে বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে, এটা যে ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকারক, এটা যে শুধুমাত্র ওই ১০,০০০ টাকা আয়ের সরল এক হিসাব নয়, এভাবে তার স্বাধীনতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ঐ জমির ভবিষ্যতও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সেটা ওদের বোঝাতে হবে। পাশাপাশি ওদেরকে সেই পথ গুলো দেখাতে হবে যাতে সেই একই জমি থেকে সে অন্তত দশ হাজার টাকা কিংবা তার বেশি আয় করতে পারে। তবেই তো সে উৎসাহ পাবে নিজের কাজে। এভাবে বোঝাতে হবে – সে যদি নিজের জমিতে ধান চাষ করে, তার সারা জীবন ধান চাল কিনতে হচ্ছে না। চাষের পাশাপাশি সেই জমির আলে সে যদি কয়েকটা পুঁইশাক বা কুমড়ো গাছ লাগায়, যেগুলো সাধারণত খুব কম আয়েশেই হতে পারে, তাহলে তাকে বাজার থেকে বেশি সবজিও কিনতে হচ্ছে না। আর যদি সেই আলের ঢাল দিয়ে কচা জাতীয় বিভিন্ন রকম বেড়ার গাছগুলো লাগিয়ে দেয়, সেই গাছের ডালপালা দিয়ে তার জ্বালানির সাশ্রয় হবে, তাকে গ্যাস কিনতে হবে না। একটা গ্যাস যদি দু’মাস চলে তাহলে সেই আটশো-হাজার টাকার সাশ্রয় হবে সেভাবে। এভাবেই যদি তার জমি ভেরিকে না দিয়ে নিজে তাকে বিভিন্ন প্রকারে ব্যবহার করার চেষ্টা করে তাহলে চাষের পাশাপাশি তার অন্যান্য আয় কিংবা খরচ সাশ্রয় হতে পারে। এই সহজ হিসাবগুলো হাতে ধরে বোঝাতে হবে তাকে।
পাশাপাশি স্বাস্থ্যের দিকটাও তুলে ধরতে হবে। যেমন শহরের লোকেরা বিভিন্ন রকম খাবার খায়, তাদের ডায়েটে যেমন শাকসবজি থাকে, তেমনি মাছ মাংস বা দুধ ডিমও থাকে। গ্রামের প্রত্যন্ত মানুষের থেকে তারা অনেক বেশি স্বাস্থ্য সচেতন, সুষম খাদ্য খাবার পাশাপাশি নিয়মিত এক্সারসাইজ করে। কিন্তু এই সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ, তারা তো ত্রাণের সময় সেভাবে খাবার বলতে পাচ্ছে হয়তো শুধু চাল আলু। কোনও কোনও সময় কিছু ডাল কিংবা চিড়ে। তার শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার কিন্তু সে পাচ্ছে না। পাশাপাশি সারাদিন তার কাটছে অলস সময়। শুধু চাল ডাল আলুতে শরীরের যেমন খামতিগুলো মেটে না ঠিক তেমনি এই যে দিনভর অবসর সময়ে তাস খেলে কাটাচ্ছে, তাতে হয়তো সাময়িক আনন্দ পাচ্ছে কিন্তু এতে তার প্রকৃত শারীরিক কসরত বলে কিছু হচ্ছে না। এই সত্যটা তাকে বোঝাতে হবে। চাষের পাশাপাশি যে সবজিগুলো সে করতে পারবে তাতে তার বিভিন্ন রকম সুষম খাবারের যে অভাব সেটা হয়তো সে পুষিয়ে নিতে পারবে। আর চাষবাস নিয়মিত করলে স্বাভাবিকভাবেই তার খাটুনি হবে, শারীরিক কসরত হয়ে যাবে। দেখা গেছে বিগত বহুবছর ধরে এই চাষবাস না করার কারণে তাদের মধ্যে চাষ করার প্রবণতাটা একদম চলে গেছে। তারা তাদের জমি বেশিরভাগই হয় ভেড়ির মালিক, না হলে ইটভাটার মালিকের কাছে বন্ধক রেখে দিচ্ছে। তার বিনিময়ে কিছু টাকা কামিয়ে নিচ্ছে, আর পায়ের উপর পা তুলে দিন কাটাচ্ছে। তাদের যে পরবর্তী প্রজন্ম – তারা হয়তো অল্প বিস্তর লেখাপড়া শিখে, কেউ ক্লাস সিক্স, কেউ এইট পাস করে কাজের খোঁজে বাইরের রাজ্যে চলে যাচ্ছে। কেউ দিল্লি, কেউ বোম্বে, এমনকি তামিলনাড়ু কেরালাতে চলে যাচ্ছে বিভিন্ন কাজের টানে। এই অল্প শিক্ষিত যুবকেরা কেউ গ্রামে পড়ে থাকছে না। গ্রামের কোন ব্যাপারেও তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ বর্তমানে নেই। যাদের মাধ্যমিক পাস কিংবা আরেকটু বেশি পড়াশোনা তারা তো আরো দূরে চলে যাচ্ছে, কেউ কেউ বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে লেবারের কাজ, বা ছোটখাটো কোনও চাকরি জুটিয়ে। খুব বেশি হলে তারা দৈনিক ৫০০ টাকার মতন পাচ্ছে। হিসাব করে দেখছে এভাবে মাসে ১৫,০০০ টাকা হাতে এসে যাচ্ছে। এটা কিন্তু ওদের কাছে অনেক টাকা। ওরা দেখেছে যে সুন্দরবনের থেকে কাজ করে মাসে পনের হাজার টাকা আয় করা অসম্ভব। সুন্দরবনে অত টাকা রোজগার করার কোন উপায় তাদের নেই। কিন্তু এটা ভাবছে না যে মাসে ১৫,০০০ টাকা আয় দেখতে হয়তো ভালো, তাদের ইনকাম হচ্ছে, কিন্তু এটা বুঝতে পারছে না যে ঐ ১৫,০০০ টাকার মধ্যে পাঁচ ছয় হাজার টাকা কম করে বাড়ি ভাড়ায় চলে যাচ্ছে এবং বাইরে খুব কষ্ট করে খেয়েদেয়ে থাকলেও মেরেকেটে চার পাঁচ হাজার টাকাই তাদের হাতে থাকছে। অথচ সেই সময়টা এবং যদি সেই খাটুনিটা সে নিজের গ্রামে দিত তাহলে বাইরে থাকার জন্য যে খরচগুলো অতিরিক্ত করতে হচ্ছে, সেগুলো করতে হতো না। এবং যে টাকাটা হাতে পেত সেটা পুরোপুরি হয়ত সে সঞ্চয় করতে পারত। এই সাধারণ হিসাবটা ওদের বোঝাতে হবে। ওরা যদি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষগুলো করতে পারে তা হলে হয়ত বিদেশ বিভুই-এ গিয়ে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে মাসে ওই যে চার পাঁচ হাজার টাকা তার এখন সঞ্চয় হচ্ছে, নিজের বাড়িতে থেকেই সেটা নিশ্চিতভাবে আরও বেশি হতে পারত। এই সরল ব্যাপারটা ওদের বোঝাতে হবে। যদিও এটা খুব সহজ কাজ না। কিন্তু প্রতিনিয়ত বলতে না থাকলে এখনও যে কজন সুন্দরবনে পড়ে আছে তারাও অদূর ভবিষ্যতে আর থাকবে না।
ওখানকার ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্সটাকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে হবে। শারীরিক কর্মকান্ড কিছু নেই বলে এখন দেখা যাচ্ছে একটু বয়স্ক লোকেরা বিভিন্ন রোগে পড়ছে। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সুষম খাবার পাচ্ছে না বলে বেশির ভাগ বাচ্চারা অপুষ্টিতে ভুগছে। ডাক্তার বদ্যির কাছে যাওয়া এক নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। অথচ সুন্দরবনে ডাক্তার বদ্যির সংখ্যা এখনও প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। আগে গ্রামের লোকেদের হার্টের সমস্যা বলে কিছু শোনা যায়নি, অথচ এখন সেখানে পয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ বয়স থেকেই হার্টের সমস্যা, ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেসার, রক্তাল্পতা খুব কমন। দেখা যাচ্ছে সাধারণত বয়স্ক লোকেরা প্রায় হাজার খানেক টাকা প্রতি মাসে ডাক্তার আর ওষুধের পিছনে খরচ করছেন। অথচ নিজেরা বিভিন্ন কাজের মধ্যে জড়িয়ে থাকলে এই খরচ সাশ্রয় হতে পারত। এই দিকগুলোকেও ওদের মাথায় ঢোকাতে হবে। সব হিসাবে এনে খাতায় কলমে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষবাসের লাভটা দেখাতে পারলে তবেই সে অন্যের কাছে জমিটা দেবে না, বরং নিজেই কাজটা করতে ব্যাস্ত থাকবে।
অন্যান্য জেলা, যেখানে চাষবাস বেশ ভালো হয়, যেমন বর্ধমান জেলার দিকে যারা পুকুরে মাছ চাষ করে কিংবা জমিতে ধান বা সবজি চাষ করে তারা কিন্তু অনেকটাই সচ্ছল। তারা চাষবাস করেই সুন্দর ভাবে সংসার চালাচ্ছে, চাষের সেই আয়েই তাদের সন্তানরা পড়াশুনা করছে। তাদের সঙ্গে যদি সুন্দরবন এলাকার একটা চাষির তুলনা করা হয় দেখা যাবে বর্ধমানের একই পরিমাণ জমির মালিক এক চাষী সুন্দরবনের সমপরিমাণ জমির মালিকের থেকে অনেক বেশি সচ্ছল। এই তুলনামূলক হিসাব দেখিয়ে যদি বোঝানো হয় যে সুন্দরবনের চাষিরা কতটা পিছিয়ে, বর্ধমান কতটা এগিয়ে, তাহলে তাদের বোঝানো যেতে পারে যে এক চাষি বর্ধমানে কৃষিকাজ করে যদি সমস্ত কিছু মেইনটেইন করতে পারে, তাহলে তুমি কেন পারবে না? গ্রামের সমস্ত চাষীদের এক জায়গায় এনে এভাবে বোঝাতে হবে। কোনও চাষিকে হঠাৎ করে যদি বলা হয় তুমি কোন ভেড়িকে কিংবা ইটভাটার জন্য জমি দেবে না, সে কেন সেই প্রস্তাবে সায় দেবে? বরং সেই জমিটা কিভাবে ব্যবহার করে যে টাকাটা সে বসে বসে পাচ্ছে তার থেকে বেশি পেতে পারে সেটা যদি হাতে কলমে দেখিয়ে দেওয়া যায় যে, এভাবেই জমিটা নিজের কাছে রেখে ব্যাবহার করলে সেই জমি থেকে বেশি আয় করতে পারবে, তবেই সে আগ্রহী হবে জমিটা নিজের কাছে রেখে নিজের মতন ব্যবহার করায়। আর এটাও তাকে বোঝাতে হবে, জমি যদি নিজের হাতে থাকে তাহলে সেই জমিতে কাজ করার স্বাধীনতা পুরোপুরি তার থাকবে। সেই জমি যদি কোন ইটভাটার মালিক কিংবা ভেড়ির মালিকের সঙ্গে চুক্তিতে চলে যায় কিছুদিন বাদেই সে জমির মালিক হওয়া সত্ত্বেও ওদের হাতের পুতুল হিসাবে পরিণত হবে।
সুন্দরবনের জমি বর্ধমানের মতন উন্নত নয় এটা ঘটনা। সেজন্য সুন্দরবনে বর্ধমানের মতন ধানের উৎপাদন হবে এটাও আশা করা যায় না। যে ধানের উপযোগী সুন্দরবনের মাটি সেটাই ওখানে চাষ করতে হবে। পাশাপাশি প্রয়োজন নোনা জলে ডুবে যাওয়া নোনা মাটিতে ধান চাষের ব্যাবস্থা করা। আমাদের সরকার ইতিমধ্যেই নোনা জলে চাষের উপযোগী বীজ ধান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। গোসাবা-৫, গোসাবা-৬, দুধেরসর, খেজুরছড়ী – এরকম বেশ কিছু প্রাজাতির ধান চাষ নোনা জলে হচ্ছে। সেই নোনাজলের ধান বিভিন্ন জমিতে লাগিয়ে তার সফল পরীক্ষা করতে হবে এবং সুন্দরবনের মানুষকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সেই আত্মবিশ্বাস নিয়ে আসতে হবে। সুন্দরবনের অধিবাসীরা বেঁচে থাকার তাগিদে যদি সবাই কলকাতার দিকে ছুটে আসে তাহলে কিন্তু তার পরিণাম হবে মারাত্মক। পাশাপাশি চাই শিক্ষা। ছোট বড় নির্বিশেষে সুন্দরবনের প্রান্তিক মানুষদের প্রথাগত শিক্ষা, জীবিকা সংক্রান্ত ব্যবহারিক শিক্ষা আর তাদের আত্মবিশ্বাস তৈরীর কাজে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আজ যেমন ত্রাণ দেওয়ার তাগিদে আপামর সাধারণ ছোট বড় দলে ছুটে যাচ্ছে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে, সেভাবেই সেই দলগুলোকে দায়িত্ব নিতে হবে এক একটি গ্রামের। একাজে প্রয়োজনমতো সাহায্য নিতে হবে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের। এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও তার যথার্থ প্রয়োগ করতে হবে সরকার ও প্রশাসনকে। ভিক্ষা নয় তারা যেন মাথা উঁচু করে নিজেদের জোরেই বাঁচতে পারে। তবেই বাঁচানো সম্ভব সুন্দরবনকে। তবেই সুরক্ষিত হবে কলকাতার ভবিষ্যৎ।
লেখক অর্জুন পুরস্কার প্রাপ্ত এভারেস্ট জয়ী পর্বতারোহী তথা বিশিষ্ট পরিবেশপ্রেমী ড:দেবাশিস বিশ্বাস ।