Garia, Kolkata, WB, India
+91-9898989898

সুন্দরবন, সাইক্লোন – বিপর্যয় এবং তার প্রতিকার : পর্ব ১

সুন্দরবন, সাইক্লোন – বিপর্যয় এবং তার প্রতিকার : পর্ব ১

বিগত বছরগুলোতে আমরা দেখছি সুন্দরবনে প্রতিবছর একাধিক সাইক্লোন এসে আছড়ে পড়ছে, আর তার পরপরই শুরু হয়ে যাচ্ছে ত্রাণ দেবার হিড়িক। সরকারি লেভেলে কিংবা বেসরকারি ছোট-বড় উদ্যোগে যে যার মত পারছে ত্রাণ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সুন্দরবনের মানুষদের উপকারের জন্য। কিন্তু এটাও তো ভেবে দেখার বিষয় যে এভাবে দিনের পর দিন ত্রাণ পাঠিয়ে তাদের আখেরে কোনো উপকার হচ্ছে কিনা? এই বিস্তীর্ণ এলাকার লোকজনকে আমরা পরোক্ষভাবে ক্রমশ ভিখারি বানানোর দিকে নিয়ে যাচ্ছি না তো! আমি নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি ওখানকার লোকেরা এরকম কোন দুর্যোগের পরপরই ত্রাণ পাবার আশায় সকালবেলাতেই থলি হাতে এসে দাঁড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন খেয়া ঘাটে, যদি কিছু পাওয়া যায় সেই আশায়। সেই দলে যেমন বয়স্ক নারী পুরুষ রয়েছে, ঠিক তেমনি থাকছে ছোট ছোট খুদেরাও। এই খুদেদের কি ছোটবেলা থেকে অজান্তেই আমরা ভিক্ষাবৃত্তি শেখাতে বাধ্য করছি না? এটা কিন্তু অবশ্যই একটা চিন্তার বিষয়। এটা এখন ওই এলাকার এক সামাজিক ব্যাধিও বটে। শুধুমাত্র ত্রাণ দিলে তাদের সমস্যার হয়ত সাময়িক এক-দু’দিনের সুরাহা হতে পারে কিন্তু সেটা কোনভাবেই সুন্দরবনের অধিবাসীদের সমস্যার পার্মানেন্ট সলিউশন হতে পারে না। দেখা গেছে এদের সমস্যার মূল সেখানকার ভঙ্গুর নদী বাঁধ। সব জায়গাতেই মাটির নদী বাঁধ বানানো রয়েছে, কিন্তু বহু জায়গায় তা ভেঙ্গে গেছে, তার যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না। সেই বাঁধ ঠিকমতন মেরামত করা হলে আর তার যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ হলে ঝড়ের ধাক্কা অনেকটাই সামলানো যাবে। আর এই নদী বাঁধের প্রধান সাপোর্ট সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ জঙ্গল। কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে যথেচ্ছভাবে কাটা হয়েছে ম্যানগ্রোভ। এখন সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় গেলে যতদূর চোখ যায় দেখা যাবে শুধু ভেরি আর ভেরি। বহু দুর দুরান্ত পর্যন্ত একটা বড় গাছ চোখে পড়বে না, এ যেন জলাশয়ের বিস্তীর্ণ এক মরু। যেখানে প্রচুর জল রয়েছে বটে কিন্তু নেই কোন সবুজের চিহ্ন। সুন্দরবন নামে রয়েছে বন, কিন্তু সুন্দরবনের বহু এলাকায় বর্তমানে বন তো দূরের কথা পাশাপাশি চারটে বড় গাছ খুঁজে পাওয়াই বেশ কঠিন।

সুন্দরবনকে বাঁচাতে প্রথম কাজ এই নদী বাঁধ সুন্দরভাবে তৈরি করে তার রক্ষণাবেক্ষণ। সাথে সাথে নদীবাঁধ বরাবর দুপাশেই বড় গাছের ঢাল, যা প্রতি বছরের ঝড়ের প্রকোপ থেকে রক্ষা করবে নদী বাঁধকে। এই নদী বাঁধ কংক্রিট করার যে দাবী উঠছে সেটা অবশ্যই খুব ভালো, কিন্তু এটা ভেবে দেখা যেতে পারে বিগত শত বছর ধরে মাটির নদী বাঁধই রক্ষা করে রেখেছিল সুন্দরবনকে। এমন তো নয় যে গত একশ বছরে কোন ঝড় এসে আছড়ে পড়েনি সুন্দরবনের উপর। কিন্তু সুন্দরবনের লোকেরা মাটির বাঁধ দিয়েই ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছিল ঝড়ের সেই দাপট। সুতরাং কংক্রিট নদী বাঁধ তৈরি করা গেলে সেটা অবশ্যই খুব ভালো কাজই হবে, কিন্তু যতক্ষণ না সেটা হচ্ছে এই মাটির নদী বাঁধ দিয়েই কিন্তু সুন্দরবনের মানুষ ঝড়কে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে, যদি তার সাথে সাথে ম্যানগ্রোভ জঙ্গলের দুর্ভেদ্য ঢাল তারা তৈরি করতে পারে। সাথে সাথে নদী বাঁধটাকে সুন্দর ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারে। আর কংক্রিট বাঁধ একবার বানিয়ে ফেললে সেটাও যে আজীবন টিকবে, তারও কোনও গ্যারান্টি কিন্তু নেই। সেই কংক্রিট বাঁধকে বাঁচাতে গেলেও তার দুপাশে – নদীর দিকে এবং লোকালয়ের দিকে, গাছের ঢাল থাকলে তবেই সেই বাঁধ বহু বছর টিকে থাকার সম্ভাবনা। না হলে নোনা জলের ধাক্কায় আর ঝড়ের দাপটে কংক্রিট বাঁধের অবস্থা হবে বর্তমান মাটির বাঁধের মতন, হয়তো দু-এক বছর আগে বা পরে।

দেখা গেছে ভেরি মালিকেরা বিভিন্ন জায়গায় নদী বাঁধ কেটে নোনা জল ঢুকিয়ে নিচ্ছে তাদের মাছ চাষের লাভের জন্য। কিন্তু সাথে সাথেই ক্ষতি করছে সেই জমির। সেখানে বেড়ে যাচ্ছে লবণের প্রভাব। লবণাক্ত জমিতে অন্যান্য বড় গাছ আর হচ্ছে না। চাষবাস হচ্ছে না। যে মিষ্টি জলের পুকুরগুলোতে মিষ্টি জলের মাছের চাষ হত, সেখানে নোনা জল ঢুকে যাওয়াতে মিষ্টি জলের মাছ চাষ করা সম্ভব হচ্ছে না। সেই জায়গাগুলো থেকে প্রথমেই নোনাজল বাইরে বের করে দিতে হবে। এবং এটা খুব বড় কাজ না। নদী বাঁধের মাঝে মাঝে কিছু গেট বানানো রয়েছে। ভাটার সময় যখন নদীর জলস্তর লোকালয় থেকে নিচে নেমে যায়, তখন ভিতরের নোনাজল সেই গেট দিয়ে অটোমেটিক বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে। সেই গেটের একমুখী ভালভ এমনভাবেই বানানো যাতে জোয়ারের সময় যখন নদীর জলস্তর বেড়ে যায় সেই জল ভিতরে ঢুকতে পারে না। সুন্দরবনে আবহমান কাল ধরে এভাবেই বন্যার নোনা জল স্বাভাবিক নিয়মেই বাইরে বেরিয়ে এসেছে। এটা কোন রকেট সায়েন্স না, এভাবে খুব সহজেই ভিতরের জল বাইরে বের করে দেওয়া যায়। আর সাথে দু-একবার বৃষ্টি হলে, বৃষ্টির জল মাটির লবণাক্ততা ধুইয়ে বাইরের নদীতে ফেলে দিতে পারে। অর্থাৎ প্রাকৃতিক উপায়েই ধীরে ধীরে জমির লবণাক্ত ভাব দূর করা সম্ভব। এবং অতীতে এভাবেই হয়ে এসেছে। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে শেষ সাইক্লোন চলে যাবার পর এত দিন পার হয়ে যাবার পরেও চাষের জমির নোনা জল সরে নি। বরং হচ্ছে উল্টোটাই। বাইরের জোয়ারের জল নিয়মিত ভিতরে ঢুকে আসছে অথচ ভাটার সময় জমির লবণাক্ত জল নদীতে গিয়ে পড়ছে না। গেট গুলো কেন উল্টো আচরণ করছে সেটা বুঝতে গেলে এলাকায় একটু কান পাতলেই বোঝা যাবে কেন এটা হচ্ছে, এর সাথে কাদের বহু ব্যক্তিগত লাভ-লোকসান জড়িয়ে?

বর্তমানে সুন্দরবনকে বাঁচাতে গেলে ত্রাণ নিশ্চয় চাই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন নদী বাঁধ মেরামত ও যথোপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ। সাথে সাথে বৃক্ষরোপণ। নদী বাঁধের বাইরের দিকে ম্যানগ্রোভ এবং লোকালয়ের দিকে অন্যান্য বড় গাছ, বিশেষত বিভিন্ন ধরনের ফলের গাছ। এখানে আম জাম কাঁঠাল লিচু পেয়ারা সমস্ত রকম ফল হতে পারে। এখানকার পরিবেশে নারকেল সুপারি গাছও ভালোই হবার সম্ভাবনা। এসব গাছগুলো নদীবাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের সাথে সাথে এলাকার মানুষকে কিছু অর্থকরী লাভও এনে দিতে পারে। গাছগুলো শুধু লাগালেই হবে না, যথেষ্ট বড় না হওয়া পর্যন্ত সুষ্ঠ যত্ন প্রয়োজন। ম্যানগ্রোভ গাছ গরু-ছাগলের খুব প্রিয় খাদ্য। গাছগুলোকে লাগানোর পর অন্তত তিন-চার বছর সুন্দরভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা অতি আবশ্যক, যাতে গাছগুলো গরু-ছাগলের নাগালের উপরে উঠে যেতে পারে। ম্যানগ্রোভ শুধু সুন্দরবনকেই বাচায় না, বর্তমানে আমরা জেনে গেছি প্রতিটা ঝড়ের দাপট প্রথমেই রুখে দেয় এই ম্যানগ্রোভের জঙ্গল। ম্যানগ্রোভ জঙ্গল রয়েছে বলেই সামুদ্রিক ঝড়ের দাপট থেকে কলকাতা তথা বাংলা অনেকটাই সুরক্ষিত। এখনই যদি এ ব্যাপারে উপযুক্ত ব্যাবস্থা না নেওয়া হয়, তবে অদূর ভবিষ্যতে ঝড়ের দাপটে শুধুমাত্র সুন্দরবনই ভাসবে না, হয়ত আরও উত্তরে ধেয়ে আসবে সেই নোনা জলের ঢেউ। এমন আশঙ্কাও অমূলক নয় যে সেই জলস্তর একদিন দক্ষিন ২৪ পরগণা ভাসিয়ে পৌঁছে যেতে পারে আমাদের এই সাধের তিলোত্তমা কলকাতার বুকে।

লেখক অর্জুন পুরস্কার প্রাপ্ত এভারেস্ট জয়ী পর্বতারোহী তথা  বিশিষ্ট পরিবেশপ্রেমী  ড:দেবাশিস বিশ্বাস 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *