Garia, Kolkata, WB, India
+91-9898989898

সুন্দরবন, সাইক্লোন – বিপর্যয় এবং তার প্রতিকার : পর্ব ২

সুন্দরবন, সাইক্লোন – বিপর্যয় এবং তার প্রতিকার : পর্ব ২

গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র এবং মেঘনা নদীর সঙ্গমে নদীগুলোর বিভিন্ন শাখা-উপশাখা ও বঙ্গোপসাগরের মাঝে নদীগুলো দিয়ে বয়ে আসা পলিমাটি দিয়ে গঠিত অসংখ্য ব-দ্বীপের ম্যানগ্রোভ অঞ্চল হল এই সুন্দরবন। এটি পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলি নদী থেকে পূর্বে বাংলাদেশের খুলনা জেলার বালেশ্বর নদী পর্যন্ত বিস্তৃত। সুন্দরবনের চারটি সুরক্ষিত অঞ্চল ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এগুলো হল সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান, সুন্দরবন পশ্চিম, সুন্দরবন দক্ষিণ এবং সুন্দরবন পূর্ব বন্যজীবন অভয়ারণ্য। সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ বন দশ হাজার বর্গ কিলোমিটারের বেশি আয়তনের, যার মধ্যে বাংলাদেশের খুলনা বিভাগের বনাঞ্চল ৬,০১৭ বর্গ কিমি এবং পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় এটি ৪,২৬০ বর্গ কিমি জুড়ে বিস্তৃত রয়েছে। ম্যানগ্রোভ অরণ্যে বিভিন্ন ধরণের গাছপালা থাকে না। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ গাছগুলির মধ্যে রয়েছে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, কেওড়া, বাইন, কাঁকরা ইত্যাদি। ম্যানগ্রোভ গাছের মধ্যে সর্বাধিক দুটি প্রজাতি হল সুন্দরী এবং গেওয়া। সুন্দরী গাছের প্রাচুর্যের জন্য সম্ভবত বনের নামটি সুন্দরবন। অন্যমতে “সমুদ্র বন” থেকে অপভ্রংশ হয়ে নাম হয়েছে সুন্দরবন। দুই দেশ জুড়ে বিস্তৃত এই বন ২৯০ ধরনের পাখি, ১২০ প্রজাতির মাছ, ৪২ রকমের স্তন্যপায়ী, ৩৫ ধরনের সরীসৃপ এবং আটটি উভচর প্রজাতি সহ মোট ৪৫৩ টি বন্যজীবনের বাসস্থান।

২০০৭ সালে, বিধ্বংসি ঘূর্ণিঝড় সিডরের হামলায় সুন্দরবনের প্রায় ৪০% জংগল ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। আবার ২০০৯ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় আইলা সুন্দরবনে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটায়। এই ঘূর্ণিঝড়ে কমপক্ষে ১০ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল। পাশাপাশি প্রতিনিয়ত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং নদীগুলো দিয়ে মিঠা জলের সরবরাহ হ্রাস পাওয়ায় এলাকার লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুন্দরবনের বেশিরভাগ স্থলভাগ সমুদ্রতল থেকে মাত্রই তিন থেকে সাত ফুট পর্যন্ত উঁচু। এখানে জোয়ারগুলি এত জোরালো হয় যে প্রতিদিন জোয়ারের সময় জল উঠে সুন্দরবনের প্রায় এক তৃতীয়াংশ জমি অদৃশ্য হয়ে যায় এবং ভাঁটাতে সেগুলো ফের জেগে ওঠে।

২০১২ সালে, জুলজিকাল সোসাইটি অফ লন্ডনের পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে সুন্দরবন উপকূল এক বছরে প্রায় ২০০ মিটার (৬৬০ ফুট) পর্যন্ত পিছিয়ে যাচ্ছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ওশানোগ্রাফিক স্টাডিজের গবেষণায় দেখা গেছে ২০১০ সালে সমুদ্রপৃষ্ঠের বার্ষিক বৃদ্ধি প্রায় ৮ মিলিমিটার (০.৩১ ইঞ্চি)। ২০০০ সালে যা ছিল ৩.১৪ মিলিমিটার, অর্থাৎ বৃদ্ধি হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় ডুবে গেছে প্রায় ১৯,০০০ একর বন অঞ্চল। ইতিমধ্যে লোহচারা দ্বীপ, নিউ মুর দ্বীপ / দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ প্রভৃতি এলাকা সমুদ্রের তলদেশে অদৃশ্য হয়ে গেছে, এবং ঘোড়ামারা দ্বীপ অর্ধ নিমজ্জিত। নিশ্চিতভাবেই এর জন্য সুন্দরবনের সাধারণ মানুষ মূলত দায়ী নয়, এর জন্য দায়ী গ্লোবাল ওয়ার্মিং। কিন্তু পাশাপাশি সুন্দরবনের সাধারণ মানুষ এবং প্রশাসন সচেতন না হলে অদূর ভবিষ্যতে এখনও পর্যন্ত সুন্দরবনের যতটুকু অবশিষ্ট রয়েছে তা বিলুপ্ত হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা।

লেখক অর্জুন পুরস্কার প্রাপ্ত এভারেস্ট জয়ী পর্বতারোহী তথা  বিশিষ্ট পরিবেশপ্রেমী  ড:দেবাশিস বিশ্বাস 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *